Sunday 2 July 2017

মতুয়ারত্ন ড. বিরাট কুমার বৈরাগ্য এর সংক্ষিপ্ত জীবনী


মতুয়ারত্ন ড. বিরাট কুমার বৈরাগ্য 

লেখক - শিমুল টিকাদার

বিশিষ্ট খ্যাতিসম্পন্য লেখক ও গবেষক ড. বিরাট কুমার বৈরাগ্য বঙ্গীয় সমাজের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র । তিনি সকলের কাছে একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক হিসেবে পরিচিত । তার কর্মগুন , কর্মস্পৃহা , কাজের প্রতি উদ্যম,  অক্লান্ত পরিশ্রম এর জন্য তিনি ইতিমধ্যেই সমাজের যুবক সম্প্রদায়ের নিকট আদর্শে পরিনত হয়েছেন । অনুরূপ তিনি সামাজিক আন্দোলন এবং নেতৃত্ব গুনের জন্য সমাজের সর্বস্তরে হয়েছেন সমাদৃত।

ড. বিরাট বৈরাগ্য ২৫ শে জুন ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় মাঝদিয়া নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবা ধীরেন্দ্রনাথ বৈরাগ্য ছিলেন একজন মতুয়া গোসাই । ধীরেন্দ্রনাথ গোসাই ১৯৮১-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বারুনীর ৭ দিন ঠাকুরবাড়ির ( ঠাকুরনগর) মন্দিরে পূজারী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন । তিনি পি. আর. ঠাকুরের সমাজ আন্দোলনের অন্যতম একজন সহযোগী ছিলেন । ড. বৈরাগ্য ছোটবেলায় তার বাবার কাঁধে উঠে বিভিন্ন মতুয়া সম্মেলনে যোগ দিতেন । তিনি তখন থেকেই তার বাবাকে খুব জানার এবং অনুসরন করার চেষ্টা করতেন । এভাবেই মূলত মতুয়া ধর্ম দর্শন এবং সমাজ আন্দোলনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ।

ড. বিরাট বৈরাগ্য এর ছাত্র জীবন ছিল বৈচিত্র্যময় । দারিদ্র সীমার নীচে থেকে পড়াশোনা করে কিভাবে জীবনে ঘুরে দাড়ানো যায় তিনি নিজে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ । তিনি ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র । পড়াশোনার প্রতি ছিল তার গভীর মনঃসংযোগ । ড. বৈরাগ্য ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী এবং প্রতিবাদী ব্যাক্তিত্ব। তিনি শিক্ষকদের নিকট খুবই স্নেহধন্য ছিলেন । তিনি তার ভাই-বোনের পড়াশোনার  জন্য নির্লস ভাবে চেষ্টা করে গেছেন ; যার ফলশ্রুতিতে তার বোন অধ্যপিকা ড. পুষ্প বৈরাগ্য এর জন্য আজ তিনি গর্বিত । অধ্যাপিকা ড. পুষ্প বৈরাগ্য একজন অত্যান্ত সুনামধন্য গবেষক এবং সুবক্তা । তিনি তার দাদা ড. বিরাট বৈরাগ্য এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে সমাজ সেবার কাজে নিযুক্ত করেছেন । বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষদের সাথে নিয়ে রাজপথে তিনি  নেতৃত্ব স্তরের ভূমিকা পালন করেন ।

১৯৭৫ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি একটি সরকারি হাসপাতালে হেলথ এসিট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন । ঠিক এর পর থেকে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবনের নতুন অধ্যায়। বি. এ. ক্লাসের পড়াশোনা, চাকুরী, ভাই-বোনের প্রতি যত্ন , পারিবারিক দায়দায়িত্ব , দারিদ্রতা সবমিলিয়ে তিনি ঐ দিনগুলোতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন । এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । তিনি ১৯৭৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ার সুযোগ পান এবং সেখানেও তিনি বিশেষ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন । অতঃপর তিনি দীর্ঘ ৯ বছর মতুয়া দর্শন এর উপর গবেষণা করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন । ড. বিরাট বৈরাগ্য এর কর্ম জীবন ছিল অত্যান্ত বৈচিত্র্যময়  - তিনি ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় হেলথ এসিট্যান্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন । তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ বিভাগে দীর্ঘ ৮ বছর যাবত গুরুত্বপূর্ন পদে চাকুরী করেছেন । এরপর তিনি হবিবপুর হাইস্কুল(উচ্চ মাধ্যমিক) এবং আরবাদি নেতাজী বিদ্যাপীঠ নামক পরপর দুটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন । স্কুল পরিচালনায় প্রশাসনিক স্তরে তার জ্ঞান, দক্ষতা এবং ব্যাবস্থাপনা ছিল চোখে পড়ার মতো । স্কুলের পরিকাঠামো, ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশ এবং অবিভাবকদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি যে নীতিমালা গ্রহন করেছিলেন তার জন্য তিনি সমাজের সর্বস্তরের সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন । অতঃপর প্রখ্যাত গবেষক ও লেখক ড. বিরাট বৈরাগ্য অত্যান্ত সুনামের সঙ্গে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ বছর অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য কে বলা হয় মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণ । বিগত কয়েক দশক ধরে তার হাত ধরেই মূলত মতুয়া ধর্ম দর্শন সারা ভারতবর্ষ সহ বহির্বিশ্বে বৃহৎ পরিসরে বিস্তার লাভ করেছে । ১৯৮৬ সালে পি. আর. ঠাকুরের নেতৃত্বে যে "মতুয়া মহাসংঘ" তৈরী হয় সেখানে ড. বৈরাগ্য ছাত্র যুব সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এরপর এসিট্যান্ট জেনারেল এবং সর্বশেষ বর্তমানে তিনি অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্বরত আছেন । তিনি দরিদ্র নিন্ম-বর্নীয় মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যায় করেছেন । দরিদ্র দিনমজুর মানুষের দুঃখ-কষ্ট , যন্ত্রণা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন । বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে মতুয়া মহাসংঘের সহযোগিতা এবং ড. বিরাট বৈরাগ্য এর নেতৃত্বে ভারতবর্ষের বিভিন্ন যায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মতুয়া আন্দোলন। বিগত দিনের আসাম ভবনে ডেপুটেশন, নাগরিকত্ব আন্দোলনে অনশন , মেদিনীপুর এবং বারাসাত এর ডি. এম. অফিসে ডেপুটেশন সহ কতিপয় গুরুত্বপূর্ন কর্মসূচি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।

ড. বিরাট বৈরাগ্য পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতবর্ষে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ । তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজেকে উদ্বাস্তু সন্তান পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন । ২০০৫ সালে ভারতের নাগপুরে উদ্বাস্তু আন্দোলনের যে নব-জাগরন ঘটেছিল ড. বিরাট বৈরাগ্য সেখানে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিলেন । এরপরে  দিল্লীর যন্তর মন্তর , ৫ই আগস্ট কোলকাতা ধর্মতলা  , কোলকাতা ওয়াই চ্যানেল সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিনি উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতৃত্বস্তরের ভূমিকা পালন করেন । "বর্তমানে নমঃশূদ্র বিকাশ পরিষদ" নামক একটি সংগঠনের সামাজিক আন্দোলনের সাথেও তিনি যুক্ত।

তিনি অপ্রতিরোধ্য । ড. বিরাট বৈরাগ্য সামাজিক আন্দোলন করতে গিয়ে শাসক গোষ্ঠীর অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন । ২০১৪ সালে ঠাকুরনগর উদ্বাস্তু আন্দোলন পক্ষে যে অনশন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল ড. বিরাট বৈরাগ্য ছিলেন তার অন্যতম প্রধান ভূমিকায় এবং পরবর্তীতে উদ্বাস্তুদের ৬ দফা দাবি নিয়ে যে রেল অবরোধ হয়েছিল তার নেতৃত্বদাতা হিসেবে সংগ্রামী জননায়ক ড. বিরাট বৈরাগ্য শাসক গোষ্ঠীর নিকট হতে প্রশাসনিক হেনস্থা এবং মামলা সহ জঘন্য চক্রান্তের স্বীকার হয়েছিলেন যা তাকে এখনও ভোগ করতে হচ্ছে ।  কিন্তু এত চক্রান্ত সত্বেও তাকে এক মুহূর্তের জন্যও দমিয়ে   রাখা সম্ভব হয়নি । শক্ত হাতে সমাজের হাল ধরে তিনি দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষের বেদনাগাঁথা কষ্টের কথা সর্বস্তরে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছেন । পরাজয় তাকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি।

মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্ম দর্শন মানুষের সমাজ জীবনে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন যাবত প্রচারের কাজ করছেন । শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা ও সমাজ নীতি সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন । তিনি কবি গানের প্রচার , প্রসার এবং সার্বিক উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থ ,শ্রম এবং সময় ব্যায় করেছেন। সম্প্রতি বৈপুরা এবং বেথুর নামে দুটি গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে  ১২,০০০ ও ১০,০০০ টাকা দান করেছেন ।  তিনি বাংলাদেশের ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং সত্যভামার মন্দির নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে ১ লক্ষ্য টাকা দান করেছেন । ৯ ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ সালে তিনি গুরুচাঁদ এসোসিয়েশন সোসাইটির ট্রাষ্টি বোর্ডে ৬ লক্ষ টাকা দান করেছেন । ড. বিরাট বৈরাগ্য এই পর্যন্ত সর্বমোট ৩২ জন অনাথ শিশুর ভরন-পোষন এবং শিক্ষার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন ; যারা সামাজে আজ প্রতিষ্ঠিত । এছাড়াও তিনি দরিদ্র দিনমজুর মানুষের নিকট বিপদে-আপদে ছুটে যান  ; তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র,  বাসস্থান, শিক্ষা,  চিকিৎসা নিশ্চিত করেন সম্পূর্ণ নিস্বার্থভাবে । তার এই মহৎ কাজের জন্য অনেকেই তাকে "দানবীর" নামে অবিহিত করে থাকেন।

মতুয়া দর্শন প্রচারের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ড. বিরাট বৈরাগ্য ১৯৭৯ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন । আনন্দবাজার, যুগশঙ্খ, গণশক্তি সহ রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে । মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য রচিত গবেষণাধর্মী  "মতুয়া সাহিত্য পরিক্রমা" বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে । মতুয়া দর্শন ভিত্তিক এই বইটিতে ফুটে উঠেছে দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষের আত্মকথা এবং প্রাধান্য পেয়েছে গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা নীতি । তাছাড়া ভারতবর্ষের ব্রাম্মন্যবাদী চক্রান্তের যে নির্মম ইতিহাস তার একটি সম্যক প্রামাণ্য চিত্র এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে । এই মূল্যবান গ্রন্থটি বের হওয়ার পর সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল , সমাদৃত হয়েছিল শিল্পী ও সাহিত্য মহলে । তাছাড়াও "মতুয়া সাহিত্য পরিক্রমা" নামক এই গ্রন্থটি ভারতের প্রতিটা রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে যা সাহিত্য ইতিহাসে বিরল।

মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য তার কৃতিত্বের জন্য দেশ এবং বিদেশ থেকে একাধিক পুরস্কার ও সন্মানে ভূষিত হন । তিনি সর্বোচ্চ সম্মান ডি. লিট. ডিগ্রী লাভ করেন ২০০০ সালে । তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বিরেন জে. শাহ্ তার হাতে ডি. লিট. এর সন্মাননা পত্র তুলে দিয়ে তাকে সম্বোর্ধিত করেন।
এছাড়াও তিনি  -
👉 "মতুয়া মিশন বাংলাদেশ" থেকে ২০০৮ সালে "মতুয়া রত্ন" উপাধি পেয়েছেন ।
👉 ২০১২ সালে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কতৃক বিশেষ সম্বর্ধনা পেয়েছেন ।
👉 কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে "আম্বেদকর পুরষ্কার" প্রাপ্তি ।
👉 মিশর, দুবাই , বাংলাদেশ থেকে বিশেষ সন্মান ও সম্বর্ধনা পেয়েছন ।
👉তিনি এই পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে সর্বমোট ৮৬  টি মানপত্র অর্জন করেছেন।

সুখ্যাত মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য একজন মানবতাবাদী সমাজ সেবক । তিনি একজন সুবক্তা ; তার প্রতিবাদী বজ্রকন্ঠে শোষকের চেতনা জাগ্রত হয় ।  মাটি এবং মানুষের সাথে তার রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক । তার ব্যাক্তিত্বের চৌকষত্ব সবাইকে মুগ্ধ করে । তিনি একজন অত্যান্ত সুদর্শন এবং সুপুরুষ । ড. বৈরাগ্য এর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর যখন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় তখন সবাই তা মুগ্ধ হৃদয়ে শ্রবন করেন।

মতুয়ারত্ন ড. বিরাট বৈরাগ্য তার কৃতকর্মের জন্য সারাজীবন আমাদের নিকট চির-স্মরনীয় হয়ে থাকবেন।

No comments:

Post a Comment

বিজেপির ভোটের রাজনীতি আর মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবনা - শিমুল টিকাদার

লিখেছেন : শিমুল টিকাদার আমরা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ । আমাদের সম্প্রদায়ের বড়ো একটি অংশ অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষ...