শিমুল টিকাদার
ধরে নিলাম নদী'টি সম্পূর্ণ স্থির । নদীতে যে পরিমাণ জল থাকার কথা তা নেই বললেই চলে । এ এক সম্পূর্ণ স্রোতহীন, ঢেউহীন এক রুক্ষ নদীর গল্প ।
এ নদীর গায়ে কখনও হাওয়া লাগে না । গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত কিংবা হেমন্ত কেমন হয় তাও সে জানে না । সেই শূন্য নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কেউ তার বুকে একটা ঢিল ছুঁড়েও মারে না । সে মরুভূমির দেশে না জন্মেও যেন মরুভূমিতেই বাস করছে । শুধুমাত্র কে যেন প্রতিদিন এসে তার বুক থেকে রক্ত চুষে নেয় । কিন্তু কে যে সে "রক্তচুষী" তা সে জানে না ; শুধু জানে সারাদিনের বিরাট একটা সময় জুড়ে সে তার কাছে প্রচন্ড তাপ-দাহ নিয়ে ছুটে আসে, তাকে খুব যন্ত্রণা দেয় । সারাদিনের সেই যন্ত্রণার আচ্ তার গায়ে রাতেও লেগে থাকে সাথে "ভয়ার্ত অপেক্ষা" আবার একটু পরেই সে আসবে । কিন্তু এভাবে একদিন সেই রক্তচুষীই (সূর্য) তার জীবনে বড়ো আপন হয়ে ওঠে এই ভেবে যে , কেউ তো একজন আছে যে তার কথা মনে রেখে প্রতিদিন ছুটে চলে আসে । হোক না সে "রক্তচুষী" । এভাবেই তার সপ্নহীন দিনগুলো কেটে যায় । জীবনের নতুনত্ব বলতে কিছু আছে বা বেঁচে থাকার আরও কোন মায়াবী কিংবা উচ্ছ্বাসে ভরা কোনো স্বার্থক মাধ্যম আছে কিনা তা সে কখনও জানতেই পারে না ।
এই কাল্পনিক নদীটির এতটাই দুর্ভাগ্য যে সে কখনও শিল্পীর তুলিতেও ধরা পড়ে নি ।
কিন্তু একদিন সব ওলট-পালট হয়ে গেল । দূর দেশ থেকে হঠাৎ আজ মেঘেদের দল ছুটে এল । আকাশে আজ সাদা-কালো রঙের মেঘমালা । ওরা এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়ায় , খেলা করে । এই দেখে আজ রক্তচুষী'টা (সূর্য) কোথায় যে পালিয়ে গেল তা আর ঠাহর হল না । ধীরে ধীরে বজ্রপাতের ঝলকানিতে চারিদিকে কম্পিত হতে লাগল , আজ কোথা হতে যে এত হাওয়া এসে নদীটির বুকে ছোট ছোট ঢেউ খেলতে লাগল তা ভাবতেই নদীটির শূন্য হৃদয় উচ্ছলতায় ভরে উঠল । একি আসন্ন নতুন কোন বিপদ নাকি বেঁচে থাকার নতুন অঙ্গীকার ; নদীটি একথাটি বারবার ভাবছে , আর তার এই একপ্রকার দুঃসময় টাই হয়ত পার করছে । সে আজ নির্বাক । কিন্তু না !! একটু পরেই ঝিরি-ঝিরি বৃষ্টিতে তার জ্বলন্ত দেহ শীতল হতে লাগল । আজ এক নতুন অনুভূতি আজ আর রক্তচুষী নেই । একটা সময় নদীর বুকে জলে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল । জলের স্পর্শে নদীর পাড়ে নতুন বৃক্ষ-রাজি তাদের আবেশ ছড়ালো , জেলেরা এল মাছ ধরতে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো নদীর বুকে মেতে উঠল উল্লাসে । একটা সময় সেই রক্তচুষীও (সূর্য) এল । কিন্তু তার প্রতি আজ আর বিরক্তির কারণ নেই । নদীটির জীবনে তার যতটুকু থাকার প্রয়োজন ঠিক ততটুকু থাকলেই চলবে ।
কাল্পনিক এই নদীটি আজ আর একা নয় ; সে আজ সবাইকে নিয়ে সেজেছে এক নতুন বেশে । আজ তার বুক ভরা জল, তার দুই পাড়ে শুয়ে আছে অসংখ্য লতা-পাতা আর গুল্ম , দাড়িয়ে আছে বৃক্ষ-রাজি । সেই বৃক্ষের ডালে বসে কোন এক অচীন পাখি তাকে ডাকে - ও নদী তোর নাম কি ? আবার কখনও মাঝিরা শোনায় গান , জেলেরা মেতে ওঠে গল্পে ..... তাই শুনে নদীটি মুগ্ধ হয় । আর এভাবেই নদীটির জীবনের একঘেঁয়েমী দূর হয়ে সে তার জীবনের নতুন স্বাদ খুঁজে পায় , সে আবিস্কার করে বেঁচে থাকার নতুন ভাষা ।
যে শিল্পীদের রং-তুলিতে এতদিন তার স্থান হয়নি এখন সেই শিল্পীরাও ছুটে চলে আসে । নদীটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা ; তার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় । এই শিল্পীরাই তখন তাদের রং-তুলিতে আবিষ্কার করল এমন একটি নদী যে নদীটি ধুঁকে ধুঁকে একসময় মরতে বসেছিল কিন্তু আজ কালের নিয়মে সে তার পাখা মেলেছে,চারিদিকে তার আবেশ ছড়িয়েছে, সে কোন কৃত্রিম রং আর রং-তুলিতে নয় বরং সে আজ সেজেছে প্রকৃতির আপন নিয়মে , তার আপন রঙে ।
ঠিক তেমনি -
মানুষের জীবনের সব চাওয়াগুলো পূর্ণ হতে থাকলে একটা সময় একঘেঁয়েমী চলে আসে ; তা হয়ত আমরা বুঝতে পারি না । মনে হয় যা চেয়েছিলাম তাই তো পেয়েছি । কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে জীবনের নতুনত্ব বা জীবনের ভিন্ন কোন স্বাদ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না । গল্পের কাল্পনিক সেই নদীর জীবনে প্রকৃতি যেভাবে হঠাৎ একদিন বজ্রপাতের সৃষ্টি করে তার জীবনের আমূল পরিবর্তন এনেছিল ঠিক তেমনি আমাদের মানুষের জীবনে এরকম হঠাৎ হঠাৎ বিষাদের ঘনঘটা চলে আসে যা হয়ত আমাদের জীবনকে এলোমেলো করে দেয় । কিন্তু একটা সময় বেঁচে থাকার তাগিদে পুরানো সেই কষ্টেভরা দিনগুলো ভুলে গিয়ে আমরা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখি, জীবন'টাকে নতুন করে সাজিয়ে নেই । দূর হয় একঘেঁয়েমী , খুঁজে পাই জীবনের নতুন স্বাদ ।