Saturday 1 July 2017

বনগাঁ-শিয়ালদহ ট্রেন ৩৩৮১৪ (লোকাল), ভোর ৪:৩৯ মিনিট ।

শিমুল টিকাদার

খুব ভোর বেলা । পৃথিবী তখন শান্ত । পাখিরও ঘুম ভাঙেনি । ল্যাম্প-পোস্টের আঁলোর নিচে কুকুরগুলিকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায় । সারারাত জেগে ওরাও এখন ক্লান্ত । আঁধার আলোর সন্ধিক্ষণে আমি হেটে চলেছি স্টেশনের উদ্দেশ্যে । দেহে কোন গ্লানি নেই,  নেই কোন বিস্বাদ,  সুখটাও ঠিক ধরা দেয় না । অবচেতন মনে জনমানব-হীন একটি রাস্তায় আমি ছুটে চলেছি। মাঝে মধ্যে সাইকেলের বেলে আমার চেতন ফিরে আসে,  এক পলক তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফেরে মাটির দিকে ।

ভোর ৪:২৮ মিনিট । ঠাকুরনগর স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে পৌছালাম । দুজন বয়স্ক মানুষ পাখার নিচে ঘুমিয়ে আছে । ওরা পাগল । হ্যা! সভ্য সমাজের সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই । ছেড়া কাঁথায় ঢাকা ওদের শরীর,  ওদিকে পা আর এদিকে মুখটা বাহিরে । ঘুমের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে মশার কামড়ে ওদের হুশ ফেরে না । কতদিন যে ওরা চুল কাটে নি দাড়ি কামায় নি,  তার হিসেব কে বা রাখে ।  কিছু সময়ের জন্য আমি দাঁড়িয়ে ওদের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম এক অন্য জীবনের গল্প - যেখানে এই মানুষগুলোর জন্ম-মৃত্যুর কোন জ্বালা নেই, সুখ-দুঃখের কোন অনুভূতি নেই ; আছে ক্ষুদার তীব্র  যন্ত্রণা, আছে শুধু অবচেতন মনে একটি দিন একটি রাত পাড়ি দেয়ার সামান্য তৃষ্ণা।

৪:৩৭ মিনিট । আমি ২ নং প্লাটফর্মে দাড়িয়ে । ট্রেন এখানে পৌছাতে ঠিক ২ মিনিট বাকি । আকাশ মেঘলা নয়, আবার একদম নীলও নয় । স্টেশনের দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালাগুলোর ভঙ্গিমা ঐ শুয়ে থাকা মানুষগুলোর মতোই মলিন । তেমন হাওয়া বইছে না কিন্তু  শীতল আবহাওয়া । শুনেছি এই সময় পৃথিবীতে কসমিক এনার্জি নেমে আসে , কিন্তু আমার তা ঠাহর হল না । মনে হল যেন ঘুম ঘুম চোখে মাথার মধ্যে হাত পা গুছিয়ে আমি শুয়ে আছি ।

ট্রেনের(লোকাল) শেষ কামরায় উঠে মাঝ বরাবর একটি সিটের চতুর্থ নং যাত্রী হলাম । এই সিটে যিনি বসেন তিনি মনে হয় পৃথিবীর বড়ো কোন এক অপরাধী । পাশের তিন জনের সঙ্গে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ করে এই চতুর্থ নং যাত্রীকে তার সিটে টিকে থাকতে হয় । তাও ভালো এই ভোরে অন্তত একটু ঘুমের ঝিমটি দিতে পারলেই শান্তি । কিন্তু মূহুর্তেই পরিবেশ বদলে গেলো, আমি হেলে থাকা মেরুদন্ড সোজা করে চারিদিকে তাকাতে লাগলাম । চারিদিকে কোলাহল আর ঘার্মাক্ত গন্ধ ।

ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করছে যাদের এক তৃতীয়াংশ মহিলা । ওদের পড়নে পুরানো ছেড়া শাড়ি । আর পুরুষদের পরনে ঢিলেঢালা ময়লা শার্ট । ওদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে ফুলের ব্যাগ । এই ট্রেনে এলিট শ্রেণীর মানুষের যাতায়াত কম;  দরিদ্র দিনমজুর মানুষের সংখ্যাই বেশী । ওদের ময়লা, পুরানো এবং ঘর্মাক্ত  কাপড়ের গন্ধে ফুলের গন্ধ হার মেনে গেছে ।

ওরা শ্রমজীবী । কেউ কোলকাতায় ফুল বিক্রি করে কেউবা জন বিক্রি করে । এই মানুষগুলোর চেহারা গড়ন দেখলে বোঝা যায় ওরা নিন্ম-বর্নীয় মানুষ । শিক্ষার আলো এখনও ওদের ঘরে পরিপূর্ণতা পায়নি । কাল থেকে কালান্তরে গায়ে খেটে ওরা জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে । আজ যারা আমার সহযাত্রী তাদেরই মতুয়া দলে ডঙ্কা কাসর হাতে দেখা যায় । আমি তখন কল্পনায় দেখি ওদের ঘার্মাক্ত দেহ , ওদের ভ্র কুণ্চিত দৃষ্টি,  ওদের কপোলে ঝিরি-ঝিরি ঘাম যা কর্ন ছুঁয়ে শেষপর্যন্ত মাটি স্পর্শ করে । তবুও ওরা ক্লান্ত হয় না । এই দৃশ্য সবাইকে জানান দেয় শাসকের শোষণ নিপীড়ন ভেদ করে আমরাও আসছি ।

৬ টা স্টেশন অতিক্রম করেছি । ট্রেনে দিনের আঁলো প্রবেশ করেছে । সূর্যের আঁলো এবং চোখের আঁলোর দ্যুতি যেন গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছে । বিভিন্ন স্টেশন থেকে উঠে আসা এই কামরার যাত্রীদের একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বসুলভ আচরন দেখে আমি মুগ্ধ হই । ওরা যে কত দিনের কত কালের বন্ধু তার কোন হিসাব নেই । ওরা এই কামরার নিত্যদিনের যাত্রী । ওরা একই সুতায় গাঁথা একটি পরিবার । সাধারনত এলিট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারটা খুব কম দেখা যায় ।

আমার চোখে মুখে এখন আর ঘুমের কোন চিহ্ন নেই; কিছুক্ষণ আগের ঘামের দুর্গন্ধটাও আমার কাছে মিষ্টি গন্ধে পরিনত হয়েছে । এখন আমি ওদেরই একজন । ওদিকে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে জানালার বাহিরে বৃষ্টি দেখছে । মাঝে মাঝে বাহিরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বিধায় ওর মা রেগে যাচ্ছে; কিন্তু সেদিকে মেয়েটির খেয়াল নেই । ওর নাম চুমকি, বয়স-৫ । মা কোলকাতা গৃহপরিচারিকার কাজ করে,  চুমকি অনেক ছোট তাই মায়ের সঙ্গেই থাকে । এই কামরার সকলেই ওকে বেশ আদরের চোখে দেখে । ----- ও পাশের একজন মধ্যে বয়স্ক মহিলা হেডফোনে গান শুনছে;  এই দেখে অন্য সকলে মিটমিট করে হাসছে । কে জানে  ? হেডফোনে গান শোনা হয়ত দরিদ্র শ্রেনী মানুষের অতিরিক্ত বিলাসিতা তাই এই হাসির কারন ।

একটু পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই -- কিছু লোক মনোযোগ সহকারে তাস খেলছে । ওদের মুখে পাতার বিড়ি । এই কামরায় ওরাও একটা বিশেষ আকর্ষণ । ওদের মুখে থাকে বিভিন্ন রকমের  লোকগীতির সুর  , সেই সুরে পরিবেশ আরও মুখরিত হয়ে ওঠে । একটু হাসি, আড্ডা, গান সঙ্গে তাস আর পাতার বিড়ি ---- ২ ঘন্টার পথ অতিক্রম করতে আর কি চাই !!

মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ব্যাগ থেকে ফুল বের করছে । কারও হাতে বেলী ,গন্ধরাজ, জবা,গাঁধা কিংবা কারও হাতে পদ্ম । ওদের মধ্যে মালতী নামের একজন  হাতে একটি পদ্মফুল নিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে । ব্যাপারটা এরকম - যার হাতে সবচেয়ে ভালো ফুল থাকবে সেই আজকের রাজা , ওদের মধ্যে প্রতিদিনই হয়তো এরকম প্রতিযোগীতা চলে ।

হঠাৎ পায়ে স্পর্শ পেয়ে আমার আনমনে উদাস ভাবটা কেটে গেল । আমি দেখলাম এক বৃদ্ধা মহিলা আমার পা ধরে বসে আছেন । উনি ভিক্ষুক নন। বয়স্ক মানুষ দেহের ভার বহন করতে পারেন না । বসার যায়গা না পেয়ে নিচেই বসে পড়েছেন । বৃদ্ধার মুখের অবয়ব দেখে খুব মায়া হল। উৎকন্ঠার প্রতিচ্ছবি । আমি ওনার দুহাত ধরে আমার সিটে বসিয়ে দিলাম । এই দৃশ্য দেখে অন্যরা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আমার খুব গর্ব হল, বুকে নেমে এলো প্রশান্তি । কিন্তু নিমিষেই আমার অপরাধবোধ হল - আমি কি এটুকু প্রশান্তির বিনিময়ে বৃদ্ধাকে সাহায্য করেছি । নিজেকে ধিক্কার । মনে হল - মানুষ আসলে নিস্বার্থভাবে কাউকে সাহায্য করতে পারে না ।

হৃদয়পুর স্টেশনে ট্রেনটা থেমে গেলো । এক বৃদ্ধ বাবা তার ১৯ বছর বয়সী এক পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে ট্রেনে প্রবেশ করল । মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেলো । আমার সহযাত্রীরা তাদের কোলাহল, আড্ডা, গান ছেড়ে সবাই ছেলেটির দিকে দৃষ্টিপাত করছে । কেউ একজন ওদেরকে বসার যায়গা ছেড়ে দিয়েছে । ছেলেটির নাম মৃত্যঞ্জয় । মৃত্যুকে জয় করেছে সে । সে কয়েক মাস আগেও এই কামরার যাত্রী ছিল , এখন মাসে একদিন ডাক্তারের নিকট যেতে হয় তার । পাটের মিলের শ্রমিক ছিল সে ; অসাবধানতা বসত মেশিনের মধ্যে হাত চলে যায় তার । মৃত্যুঞ্জয় এর বাবা গভীর উৎকন্ঠার সহিত তার ছেলের শারীরিক খোঁজ খবর সবাইকে  জানাচ্ছেন । এই অসহায় মৃত্যঞ্জয় এর প্রতি সবার যে কত আবেগ কত ভালোবাসা আমি দাঁড়িয়ে থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম । হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে কে যেন ঐ ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল । একটু খানি এগিয়ে দেখলাম জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা চুমকি নামের সেই মেয়েটি সবাইকে অতিক্রম করে একটি লাল রঙের জঁবা মৃত্যুঞ্জয়ের সম্মুখে ধরে আছে । মৃত্যঞ্জয়ের হাত নেই । সে ঐ লাল জবার ন্যায় ছলাৎ ছলাৎ চোখে চুমকির দিকে তাকিয়ে আছে । ছোট্ট চুমকির ভালোবাসায় মৃত্যুঞ্জয় এর চোখ থেকে আজ সুখের কান্না ঝরছে.........!!

মনের মধ্যে জীবনের গভীরতম প্রদেশের সুখের দুঃখের গল্পগুলি একে সকাল ৬ : ৩২ মিনিটে শিয়ালদহ প্লাটফর্মে  নেমেছিলাম । আমি দাঁড়িয়ে আছি । পুরো ট্রেনটাকে আমি একবার দেখে নিলাম । আবারও ছুটে গেলাম সেই শেষ কামরার ধারে; জানালার বাহির থেকে তাকিয়ে দেখি ভেতরে কেউ নেই । শূন্য ।
 হৃদয়ের গহীনে ধ্বনিত হতে লাগল রবি ঠাকুরের সেই কবিতাটি  --

      কোথায় আঁলো কোথায় ওরে আঁলো
      বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো
      রয়েছে দ্বীপ না আছে শিখা
      এই কি ভালো ছিল কি লিখা
      ইহার চেয়ে মরন সেযে ভালো
      বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো ।।

2 comments:

  1. হার্দিক লেখাটির জন্যে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. অনুপম রায় ঝাঁ বাবু
    আপনি আমার এই লেখাটি পড়েছেন জেনে আমি খুবই আনন্দিত । আপনাদের মন্তব্য আমাকে উৎসাহিত করে । ধন্যবাদ ।

    শিমুল টিকাদার
    fb/shimul.tikadar

    ReplyDelete

বিজেপির ভোটের রাজনীতি আর মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবনা - শিমুল টিকাদার

লিখেছেন : শিমুল টিকাদার আমরা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ । আমাদের সম্প্রদায়ের বড়ো একটি অংশ অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষ...