Wednesday 29 March 2017

বিবাহ বিজ্ঞাপন


শিমুল টিকাদার

আমি আনন্দবাজার পত্রিকা একদম পড়ি না বললেই চলে । কেননা সাদা কে কালো আর কালো কে সাদা বানানো এই পত্রিকার নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ । তবে রবিবার এর সংখ্যায় একটা অতিরিক্ত "রবিবাসরীয়" নামক সংখ্যা  থাকে এবং সেখানে ভালো কিছু লেখা থাকে বিধায় সপ্তাহের  এই একটা দিনই এই পত্রিকা সংগ্রহ করি । অন্যদিকে যুগশঙ্খ  পত্রিকার মান যথেষ্ট ভালো কিন্তু সেখানে আন্তর্জাতিক খবর, বিনোদন,  খেলাধুলা ইত্যাদি চর্চার তেমন সুযোগ নেই বলে আমার একঘেঁয়ে লাগে । এসব বিবেচনা করে দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকা টা আমি বাড়িতে নিয়মিত রাখি ; এই পত্রিকাটি ঐসব ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট সক্ষম ।

এবার আসল কথায় আসি --
আগেই বলেছি ভালো কিছু লেখা পড়ার লোভে  রবিবার আনন্দবাজার পত্রিকা সংগ্রহ করি । এই সংখ্যার "রবিবাসরীয়" নামক অতিরিক্ত সংখ্যার পৃষ্ঠাগুলোতে খুব উচ্চ  মানের লেখা থাকে তা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই । কিন্তু এই "রবিবাসরীয়" সংখ্যার বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা  জুড়ে থাকে বিবাহের বিজ্ঞাপন । আমি সেখানে প্রায়শই চোখ বুলিয়ে নেই । পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থাকবেই তাতে কোন সমস্যার কারন নেই ।

কিন্তু আমি এই বিজ্ঞাপনগুলোর লেখা দেখে অবাক হয়ে যাই । ৯৯.৯৯ শতাংশ বিজ্ঞাপনেই দেখি পাত্র বা পাত্রীর  কাস্ট  আগে উঠে আসে । সে হয় ব্রাহ্মণ নয়তো  কায়স্ত । এবং বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয় ব্রাহ্মণ বা কায়স্ত ব্যতিরেকে অন্য কাস্ট হলে বৈবাহিক  সমন্ধ হবে না । আবার মুসলিমদের বৈবাহিক  বিজ্ঞাপনে শিয়া-সুন্নির ভাগও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায় । এই বিজ্ঞাপন পাতায় নমঃশূদ্র পাত্র-পাত্রীদের বিজ্ঞাপন খুবই কম থাকে ; হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ।

এখন দেখুন  - বিজ্ঞাপনে এই ঝন্ডাবাহি ব্রাহ্মণ/কায়স্ত পাত্র'-পাত্রীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ থাকে । কেউ ডাক্তার , কেউ  ইঞ্জিনিয়র , কেউবা সরকারের বড়ো কোন আমলা ইত্যাদি ইত্যাদি । এরা নিশ্চয়ই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীধারী  - কেউ পড়েছে বিজ্ঞান কেউবা দর্শন । এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞান কিংবা দর্শন কি তাদের  উচ্চবর্ণীয় জাতি পরিচয়ের অহমিকা শিখিয়েছে ? নিশ্চয়ই নয় ।
ভাবতে অবাক লাগে  - এরা দর্শনে এরিস্টাটল  , ডেল কর্নেগী চর্চা করে কিংবা বিজ্ঞানে ডারউইন এর বিবর্তনবাদ পড়ে পরীক্ষার খাতায় পাশ করে নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে জাহির করছে ; আবার এদিকে বিবাহের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে এসে জাতের ঝাণ্ডা ধরছে  ।
ছিঃ !! এ যে শিক্ষিত সমাজের লজ্জা  !!

একটা শুদ্রের মেয়ে - ব্রাহ্মণের ছেলে কিংবা
একজন ব্রাহ্মণ পরিবারে মেয়ে - শুদ্রের ছেলে
কি পরস্পরের জীবনসঙ্গী হতে পারে না  ? পাত্র-পাত্রীর  পরস্পরের ইচ্ছা/চাহিদা থাকলে কেন তারা পারবে না । আজকের এই  বিজ্ঞানের যুগে এই অপ্রসাঙ্গিক বর্নীয় সমস্যা/কুসংস্কার/মনের ব্যামো প্রকট আকারে থেকেই গেছে । হাতে গোনা গুটিকয়েক ভিন্ন-মাত্রার উদাহরণ ছাড়া আসলে তেমন ভাবে অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না ।

তবে সব ব্রাহ্মণ/কায়স্ত পরিবার এই ভুলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা আমি বলছি না । তাদের মধ্যে মডার্ন ফ্যামিলিও আছে যারা এই ভুল থেকে বেরিয়ে এসেছে ;  কিন্তু তাদের সংখ্যাটা খুব কম ।

বৈবাহিক সম্পর্ক আমার কাছে শুধুমাত্র সংস্কৃত ভাষায় কয়েক লাইন ভুলভাল উচ্চারণ  আর সামাজিক অনুষ্ঠান সাথে জাত-পাতের বিচার-বিশ্লেষণ নয় । বিবাহ মানে তো পারস্পরিক ভালোলাগার  নিরিখে সারাজীবন একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার। সেখেত্রে প্রিয় মানুষটি যে কোন বর্ণের , যেকোন গোত্রের , যেকোন ধর্মের হতে পারে ।
আর এটাই তো একুশ শতকের "মুক্তচিন্তা" । ভুল বললাম কি  ?

এছাড়াও প্রায়শই শোনা যায় কর্মক্ষেত্রে  - একই পোস্টে চাকুরী করার পরেও নিন্ম-বর্নীয় চাকুরিজীবীদের তাদের সহকর্মী উচ্চ বর্নীয়দের কাছে প্রভুত্বের শিকার হতে হয় ।  উত্তরপ্রদেশের অনেক মন্দিরে নিন্ম-বর্নীয়দের ঢোকার অনুমতি নেই  , স্বামী -স্ত্রী কে নগ্ন করে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাড় করিয়ে রেখে মজা দেখা হয়  -- এসব ঘটনা  মিডিয়ায় প্রায়শই উঠে আসে ।

এই ঘটনাগুলো বহুকাল ধরে চলে আসছে আমাদের এই ভারতবর্ষে । রাষ্ট্র কে দ্বায়িত্ব নিয়েই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে । এজন্য  শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে । সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুনীজন /বিদ্বজন'দের উঠে এসে কথা বলতে হবে । নয়তো নিন্ম-বর্গীয়দের প্রতি এহেন সামাজিক বঞ্চনা কোনদিন দূর হবে না । বরংচ তাদের অনন্ত কালের জন্য বয়ে বেড়াতে হবে মানসিক দাসত্ব ।

আজ আসি । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পরিবার কে পিরীলির ব্রাহ্মণ বলা হত কেন  এবং এত নাম যশ অর্থবৃত্ত থাকা সত্ত্বেও  তার পরিবারের সাথে উচ্চ-বর্গীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার কেন কোন বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করত না তখন - সেই ঐতিহাসিক গল্প নিয়ে অন্য একদিন হাজির হব । ভালো থাকবেন....!!

No comments:

Post a Comment

বিজেপির ভোটের রাজনীতি আর মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবনা - শিমুল টিকাদার

লিখেছেন : শিমুল টিকাদার আমরা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ । আমাদের সম্প্রদায়ের বড়ো একটি অংশ অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষ...