শিমুল টিকাদার
হৃদয় যাকে ছুঁয়ে যায় পরাজয় যাকে কাঁদায় - তার নাম মানবতা ।
আর এই মানবতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে একটি মনুষ্য সমাজ , রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের গনতন্ত্র । ভারতবর্ষ তার গনতন্ত্র রক্ষায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ।
কিন্তু দেশ ভাগের পর পাকিস্তান এমন একটি অসভ্য-ইতর শ্রেনীর দেশে পরিণত হয় যার আজও নেই কোন মানবতা কেন্দ্রীক সমাজ, নেই কোন গনতন্ত্র । আজকের পাকিস্তান এর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের অগনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ঠিক পাকিস্তানের আদর্শেই গড়ে উঠেছে ; যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের কোন নিরাপত্তা নেই । এদেশের খুন, গুম , হত্যা, ধর্ষণ,লুণ্ঠন, নারী নির্যাতনের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তা নিশ্চয়ই সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ।
দেশ ভাগের পর থেকে এই এ অসহায় মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে ভারতে চলে আসে । বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের অসম , ত্রিপুরা এবং পশ্চিম সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গ হয় তাদের জীবনের শেষ ঠিকানা ।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন -
দেশভাগের পূর্বে এই অসহায় সাধারন মানুষগুলো সবাই কিন্তু একদিন ভারতীয় নাগরিক ছিল ; অথচ দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত তাদের মতামত না নিয়েই নেয়া হয়েছিল । যে মূহুর্তে তারা জানতে পেরেছিল এই দেশ ধর্মীয় সমীকরণে ভাগ হয়ে গেছে অর্থাৎ হিন্দু হওয়ার অপরাধে নিজের দেশে তারা আজ পরবাসী/পরাধীন সেই মূহুর্তে তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল ।
জনবিনিময় হওয়ার কথা থাকলেও আদৌ পূর্ব বাংলার হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি । ফলে পাকিস্তানী/বাংলাদেশী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়েই তাদের ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে হয় ।
কিন্তু ভারতে এসে এই উদ্বাস্তু মানুষের দুঃখ-কষ্টের আর সীমা ছিল না । এই অসহায় মানুষগুলোর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের আচরন ছিল বিমাতৃসুলভ । তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এই উদ্বাস্তু মানুষের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে তাদের জন্য খুলেছিল কয়েক হাজার ক্যাম্প । যেখানে খাদ্য, বস্ত্র , চিকিৎসার অভাবে তারা ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছিল । এরপরেও কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষ্যান্ত হয়নি - এই অসহায় মানুষগুলো'কে তারা পাঠায় বর্তমান ছত্তিশগড় , আন্দামান সহ কয়েকটি প্রদেশে যেখানে তখন ছিল মানুষের বসতি-হীন অর্থাৎ অত্যান্ত দুর্গম অঞ্চল । শেষ পর্যন্ত রোগাক্রান্ত হয়ে সেখানে হাজার হাজার উদ্বাস্তুদের মৃত্যু হয় । ঐসব অঞ্চল থেকে জীবনের অর্ধেক খুইয়ে অনেকেই আবার বেঁচে ফিরেছিল পশ্চিমবঙ্গে ।
তখন পশ্চিমবঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল অন্য এক কলঙ্কিত ইতিহাস -
এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে কিছু মানুষ ক্যাম্প থেকে ছুটে গিয়েছিল সুন্দরবনস্থ মরিচঝাপিতে । সেখানে তারা ঘর বেঁধে বেঁচে থাকার নতুন সপ্ন দেখেছিল । জঙ্গলের কাঠ কেটে আর মাছ ধরে তারা জীবীকা নির্বাহ করতে শুরু করেছিল । কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়াল পশ্চিমবঙ্গ জ্যোতিবসুর রাজ্য সরকার । যে সংগঠনগুলো এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর নিকটে সাহায্য পৌঁছে দিতে গিয়েছিল তাদের উপর কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল । সেখানের পানীয় কলগুলোকে সিল করে দেয়া হয়েছিল । এখানেই শেষ নয় - পুলিশ পাঠিয়ে চালানো হয়েছিল নারকীয় গনহত্যা । বিনা বিচারে মরন-বরন করে নিয়েছিল হাজার হাজার উদ্বাস্তু ।
অবশেষে উদ্বাস্তুদের স্বপ্নের মরিচঝাপির ইতিহাস মরীচিকায় পরিনত হয়ে সেখানেই ভেঙে গিয়েছিল তাদের বেঁচে থাকার মেরুদন্ড । তখন তারা আবার দণ্ডকারণ্যে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল ।
ঠিক এভাবেই অসম , পশ্চিমবঙ্গ , ত্রিপুরা সহ সারা ভারতবর্ষে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের রক্তে রচিত হতে থাকে এক একটি কলঙ্কিত ইতিহাস । এবং আজও তা থেমে নেই ।
সেদিন যখন জানা গিয়েছিল অসমের একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রায় ২০০ জন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের বন্দি করে নির্যাতন করা হচ্ছে যার মধ্যে প্রায় শতাধিক নারী-শিশু ; তখন আর্তমানবতার ডাকে অর্থাৎ তাদের উদ্ধার করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ডাঃ সুবোধ বিশ্বাস এবং নিখিল.ভারত বাঙালি.উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতি সংগঠনের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ । কিন্তু কিছু দুষ্কৃতীকারী অর্থাৎ তৃতীয় কোন শক্তি ডাঃ সুবোধ বিশ্বাস নেতৃত্বাধীন এই সংগঠন এবং অসমীয় আসু সংগঠন ও প্রশাসনের মধ্যে একটি পরিকল্পিত দাঙ্গা লাগিয়ে দেয় । যার ফলে বাঙালি-অসমীয়দের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দের সৃষ্টি হয় । ডাক্তার সুবোধ বিশ্বাস মহাশয়ের উপর জারি করা হয় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ।
এই ঘটনায় আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা মানবতাবাদী প্রাণ গভীরভাবে চিন্তিত । ডাক্তার সুবোধ বিশ্বাস এবং নিখিল.ভারতের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অসম সরকার বিনা-বিচারে বিনা-তদন্তে যে প্রশাসনিক হেনস্থার বাতা-বরন তৈরী করেছেন তার জন্য আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন । আমরা অসমের শিক্ষিত সুশীল সমাজের কাছে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার শান্তিপূর্ন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার জন্য আহবান জানিয়েছিলাম - কিন্তু এখনও সাড়া না পেয়ে আমরা খুব মর্মাহত ।
কিন্তু আমরা এখনও আশাহত হইনি । আমরা অসমীয় ভাইদের একটি সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় অধীর-আগ্রহে অপেক্ষা করছি ।
কোন একটি ঘটনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমান , যুক্তি , বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদি পরিস্ফুটনের মাধ্যমে আমরা যখন কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসি এবং কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করি -- তার নাম বিবেক । অর্থাৎ বিবেক হল একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ।
আমরা বাঙালিরা অসমীয় ভাইদের আবারও একবার আহবান জানাই -
বর্তমানে অসমীয়-বাঙালিদের মধ্যে যে সংকট চলছে আসুন আমরা উভয় পক্ষ মিলে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হয়ে বিবেকের পরিচয় দেই।
আমরা হিংসা চাই না আমরা শান্তি চাই । আমরা বাঙালিরা অসমীয় ভাইদের প্রানে প্রাণ মেলাতে চাই । আমরা নিরপরাধ ডাক্তার সুবোধ বিশ্বাস মহাশয়ের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার সহ নিখিল.ভারতবাঙালি.উদ্বাস্তু সংগঠনের সকল সদস্যবৃন্দের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলা থেকে অব্যাহতি চাই । আমরা চাই অসমীয়-বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল সৃষ্টি করতে গত ০৬/০৩/২১০৭ ইং তারিখে যে তৃতীয় শক্তির উত্থান হয়েছিল তাদের মুখোশ উন্মোচিত হোক ।
অসম সরকারের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন এই যে - গত ০৬/০৩/২০১৭ ইং তারিখে অসমীয়-বাঙালিদের মধ্যে যে অসহিষ্ণুর বাতা-বরন তৈরী হয়েছিল তার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে নিরপেক্ষ "তদন্ত কমিশন গঠনে" এগিয়ে আসুন ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ভারতের জন-গন-মন , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বন্দেমাতরম, মাস্টারদা সূর্য সেনের দেশপ্রেম আমাদের যেভাবে জাতীয়তাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে কিংবা ভূপেন হাজারিকা'জীর "মানুষ মানুষের জন্য " গানটি আমাদের যেভাবে মানবপ্রেম শিখিয়েছে ঠিক সেভাবেই আসুন আমরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতির পরিচয় দেই ।
আমরা ভারতীয় । এই মূহুর্তে অসমে-বাঙালিদের ভারতীয় সত্ত্বার কথা মাথায় রেখে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদের সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বিশ্ব-দরবারে পরিচিত হওয়া একান্ত কাম্য ।
আমরা বাঙালিরা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করার প্রত্যায়ে অসমীয় ভাইদের হাতছানি দিয়ে ডাকছি ; আপনার সাড়া দিন ।
আমাদের ডাকে আপনাদের একটি সবুজ সঙ্কেত'ই আগামী দিনের সুখী-সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ তৈরী করতে পারে ।
No comments:
Post a Comment